সংকোচে জানাই আজ: একবার মুগ্ধ হতে চাই।
তাকিয়েছি দূর থেকে। এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি।
এতদিন সাহস ছিল না কোনো ঝর্ণাজলে লুণ্ঠিত হবার -
আজ দেখি অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে …
জানি, পুরুষের কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছো।
তোমাকে ফুলের দেশে নিয়ে যাবে ব’লে যে-প্রেমিক
ফেলে রেখে গেছে পথে, জানি, তার মিথ্যে বাগদান
হাড়ের মালার মতো এখনো জড়িয়ে রাখো চুলে।
আজ যদি বলি, সেই মালার কঙ্কালগ্রন্থি আমি
ছিন্ন করবার জন্য... অধিকার চাইতে এসেছি? যদি বলি
আমি সে-পুরুষ, দ্যাখো, যার জন্য তুমি এতকাল
অক্ষত রেখেছো ওই রোমাঞ্চিত যমুনা তোমার?
শোনো, আমি রাত্রিচর। আমি এই সভ্যতার কাছে
এখনো গোপন ক’রে রেখেছি আমার দগ্ধডানা;
সমস্ত যৌবন ধ’রে ব্যধিঘোর কাটেনি আমার। আমি একা
দেখেছি ফুলের জন্ম মৃতের শয্যারপাশে বসে,
জন্মান্ধ মেয়েকে আমি জ্যোৎস্নার ধারণা দেব ব’লে
এখনো রাত্রির এই মরুভুমি জাগিয়েরেখেছি।
দ্যাখো, সেই মরুরাত্রি চোখ থেকে চোখে আজ পাঠালো সংকেত -
যদি বুঝে থাকো তবে একবার মুগ্ধ করো বধির কবিকে;
সে যদি সংকোচ করে, তবে লোকসমক্ষেদাঁড়িয়ে
তাকে অন্ধ করো, তার দগ্ধ চোখে ঢেলে দাও অসমাপ্ত চুম্বন তোমার…
পৃথিবী দেখুক, এই তীব্র সূর্যের সামনে তুমি
সভ্য পথচারীদের আগুনে স্তম্ভিত ক’রে রেখে
উন্মাদ কবির সঙ্গে স্নান করছো প্রকাশ্য ঝর্ণায়।
তুমি আমাকে ভুলে যাবে, আমি ভাবতেই পারি না।
আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে তুমি
আছো এই সংসারে, হাঁটছো বারান্দায়, মুখ দেখছো
আয়নায়, আঙুলে জড়াচ্ছো চুল, দেখছো
তোমার সিঁথি দিয়ে বেরিয়ে গেছে অন্তহীন উদ্যানের পথ, দেখছো
তোমার হাতের তালুতে ঝলমল করছে রূপালি শহর,
আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে
তুমি অস্তিত্বের ভূভাগে ফোটাচ্ছো ফুল
আমি ভাবতেই পারি না।
...
যখনই ভাবি, হঠাৎ কোনো একদিন তুমি
আমাকে ভুলে যেতে পারো,
যেমন ভুলে গেছো অনেকদিন আগে পড়া
কোনো উপন্যাস, তখন ভয়
কালো কামিজ প'রে হাজির হয় আমার সামনে,
পায়চারি করে ঘন ঘন মগজের মেঝেতে,
তখন একটা বুনো ঘোড়া খুরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে আমাকে,
আর আমার আর্তনাদ ঘুরপাক খেতে খেতে
অবসন্ন হয়ে নিশ্চুপ এক সময়, যেমন
ভ্রষ্ট পথিকের চিৎকার হারিয়ে যায় বিশাল মরুভূমিতে।
::: যদি তুমি ফিরে না আসো ::: শামসুর রাহমান :::
যদি ভালোবাসা, প্রিয়, আমাকে বাঁচাতে পারে বাঁচবো তাহলে-
খসে পড়া তারাগুলো নাহলে আমাকে নিয়ে
মৃত তারাদের দেশে চলে যাবে-
সেখানে সমাধি হবে আমারও বা
লেখা হবে, আজব বিচিত্র এক নীল তারা, চশমাধারী প্রজাপতি,
এখানে ঘুমোচ্ছে সারা জীবনের ঘুমে,
যে তারাটি একা একা ছাতে বসে বুঝতে চেয়েছিল
ভালোবাসা আজো কেন বিক্রি হবে চড়া দামে
ভালোবাসা, রাজারহাটের তিন বেডরুমের মোলায়েম ফ্ল্যাট নাকি কোনো?
শাদা কোনো টাটা সুমো?...
হলুদ বালিতে যায় ভরে যায় দেশ-বিদেশ, যাকে তোমরা মরুভূমি বলো
সে মরুবালিও পথ শুঁকে শুঁকে এসে গেছে আমাদের ঘরে
এসো তুমি ধবধবে বিছানায় দুঘন্টায় ধন্য হও পথের কুটীরে
তিন গ্লাস স্বাধীনতা সঙ্গে পাবে
শুধু তুমি, এখনো কেন যে ভাবো, ভালোবাসা
ভালোবাসা মৃতসঞ্জীবনী
:::ভাস্কর চক্রবর্তী:::
ভালোবাসো এবং বাসো...
আনিসুল হক
ভোরের পল্লবে দু ফোঁটা অশ্রু
আমাকে ডাক দেন আমীর খসরু।
রামুর বুক চিরে উপড়ে ফেলা হৃৎ
আগুন জ্বলে বনে, জ্বলছে সম্বিৎ
পুড়ছে ভগবান, পুড়ছে লোকালয়...
এতটা হিংস্রতা, এতটা নিহৃদয়
সীমানা ওপাড়েও দগ্ধ মানবতা,
মানুষ পুড়ে যায়, শিশুর কোমলতা
শিশুর হাসি পোড়ে শিশুর কান্না
তবে কি ভালোবাসা এখানে আর না
বন্যা বহে দেয় ভূগোলে অশ্রু
প্রেমের সুধা পিয়ে ডাকেন খসরু
বলেন ভালোবাসি ডুবেছি প্রেমেতেই
এ জলে সেই বাঁচে যেজন ডুবেছেই
যেজন সাঁতরায় সে জন ডুবে মরে
সাঁতার জানো না হে, তুমি তো গেলে ত’রে।
নিজাম আউলিয়া বলেন ভালোবাসো,
আমীর খসরুও বলেন, ভালোবাসো
ইমন রাগ ফোটে সান্ধ্য নীলিমায়
খসরু বেহালায়, বলেন ওরে আয়
বুকেতে টেনে নাও, প্রেমের শুরা পিয়ে
পৃথিবী ঢেকে দাও ভালো ও বাসা দিয়ে
তোমার তরণীতে বুঝিবা মাঝি নাই
ওপরে খোদা আছে ওপরে আছে সাঁই
যে জন সেই রূপে মজেছে একবার
তাকে কে ডোবাবে রে, সেজন হবে পার
প্রেমের ব্যাধি যাকে গ্রস্ত করে রাখে
হাকিম কোবরেজ সারাতে পারে তাকে?
দূরো হে ডাক্তার, তোমার কাজ নয়,
প্রেমের রোগেশোকে প্রেমেই কাজ হয়--
প্রেমাস্পদে তার শয্যা পাশে আনো
পাবে সে আরোগ্য, পাবে সে নির্বাণও
চর্তুদিকে আজ এত যে অশ্রু
দু চোখ মুছে দেন আমীর খসরু
খোদার প্রেমে তিনি এতই দিওয়ানা
বলেন দূরে রাখো মুসলমানিয়ানা
বলেন দূরে রাখো হিন্দু বন্ধনী
দুচোখে পরে রাখো প্রেমের অঞ্জনই।
ভূগোল জুড়ে আজ এতটা ক্রোধ রূঢ়
ইমন রাগ কই আমীর খসরুর
সূর্য ডোবে পাটে, আকাশে লাল মেঘ
পাখিরা ফেরে ঘরে, কোথাও উদ্বেগ
ইমন ফুটে ওঠে বেহাগে তবলায়
শিশির জমে ঘাসে, ডাকে সে ইশারায়
ভালোবাসাই পারে ভালোকে বাসতে
ভালোবাসাই পারে হিংসা নাশতে
আঘাত যদি পাও যদি প্রত্যাখ্যান
তবুও ভালোবাসা হোক না ধ্যানজ্ঞান
ভালোকে বাসা দিয়ে যদি বা ঠকে যাও
তবুও জিৎ এ যে, হৃদয় ঢেলে দাও
এত যে টর্নেডো বাগান ধ্বস্ত
তবুও ভালোবাসি জোছনাগ্রস্ত
আঘাত করো যদি বিষাল কাঁটা দিয়ে
বলব ভালোবাসি, সুখী কি হলে প্রিয়ে?
বলো না যাই কেন, বলব একথাই
প্রেম ও ভালোবাসা দাওয়াই একটাই
আমাকে ঘৃণা করো? তবুও ভালোবাসি
মারবে নিষ্ঠুর। প্রেমেতে তবু হাসি।
চতুর্দিকে আজ এতটা অশ্রু
প্রেমেতে ডুবে রন আমীর খসরু
ধ্বংসযজ্ঞতে দুনিয়া দেউলিয়া
প্রেমের শুরা ঢালে নিজাম আউলিয়া
সে সুরা পান করে আমীর খসরু
মাতাল হয়ে যায় আনখশশ্রু
আঘাত যত পাও ততই ভালোবাসো
যতই দূরে ঠেলে ততই কাছে আসো
যতই রটিয়েছে সর্বনাশশিখা
হৃদয়ে প্রেম জ্বলে কপালে প্রেম টিকা
প্রেমের মজমায় নিজেকে ভুলে যাও
প্রেমের সুরালোকে দুনিয়া ঢেকে দাও
ভালোবাসার পর আঘাত যদি আসে
প্রিয়র প্রণীত তা, হৃদয় তাই হাসে
তোমরা চলে যাও যেখানে চায় দিলে
এখানে আমি রব, প্রেমের মঞ্জিলে
তোমরা চলে যাও যতটা লাভ নিতে
প্রোথিত রব আমি প্রেমের সমাধিতে
বলো না যাই কেন, বলব ভালোবাসি
মারো বা কাটো যত, জবাব ভালোবাসি
আমাকে ত্যাগ করো, বলব, ভালোবাসি
আমাকে জ্বেলে মারো, বলব ভালোবাসি
আমার ছাই থেকে জাগবে শ্যামফুল
আমার গোর থেকে ফুটবে কচিপাতা
বলবে ভালোবাসি, বলবে, ভালোবাসো
চতুর্দিকে শুধু ভালোবাসাই পাতা
আকাশে এত আলো, বলছে, ভালোবাসো,
আকাশে এত মেঘ, বলছে, কাছে আসো
দু চোখে পরেছি যে প্রেমের অঞ্জন
আমাকে দোষ দিও, দিও বা গঞ্জন
লোকটা ছিল খুব বাজে অসামাজিক
কিন্তু প্রেমে তার আস্থা ছিল ঠিক
বেসেই ভালো ঠিক লোকটা মরল
ভালোবাসানলেই কেবল জ্বলল
মরতে হবে জানি প্রেমেই মরা ভালো
প্রেমের নীলাভায় পৃথিবী করে আলো
চর্তুদিকে আজ এত যে অশ্রু
আমাকে প্রেম কহে আমীর খসরু
প্রেমেরই আছরেতে আমিও দিওয়ানা
তোমাকে ভালোবাসি বলতে ভাবব না
শুরুতে প্রেম ছিল শেষেও প্রেম ধ্রুব
প্রেমেই জয় আর প্রেমেই পরাভব
প্রেমেই শ্বাস নিই প্রেমেই শ্বাস ছাড়ি
প্রেমেই খাই পরি প্রেমেই ঘরবাড়ি
এবং ভালোবাসো আবার ভালোবাসো
যদিও ভালোবাসো তবুও ভালোবাসো
সর্বনাশাদের এভাবে সব নাশো
ঘৃণার বিপরীতে আবারও ভালোবাসো।
ঘটুক যাই আমি বাসব শুধু ভালো
ঠকি বা জিতি আমি বাসব শুধু ভালো
তোমরা বোকা বোলো পাগল নামে ডেকো
প্রেমেই মরে আছি একথা মনে রেখো।
দুচোখে পরে আছি প্রেমের অঞ্জন
প্রেমেই পাই তাকে যিনি নিরঞ্জন
পুড়ছে মন্দির পুড়ছে লোকালয়
প্রেমের জলে নিভে একদা হবে জয়
ঘৃণার বিনিময়ে দিয়ে যা ভালোবাসা
জগতে প্রেম ধ্রুব ধ্রুব যে তাই আশা।
বক্ষে ঘৃণা নিয়ে ওরা কী করে বাঁচে,
ভালোবাসার টানে ওদের নাও কাছে।
পৃথিবী দু নয়ানে দু ফোঁটা অশ্রু
প্রেমের ছোঁয়া দিই আমি ও খসরু।
#ভালোবাসার দিনে
–সৈয়দ শামসুল হক
রাতের অন্ধকার এখন আমার ছবি আঁকার ক্যানভাস ।
তোমার চোখের আলো আমার রঙ ।
একদিন তোমাকে যে ছুঁয়েছি সেই আঙুল আমার তুলি এখন ।
আমি তোমার ঘুমের ছবি আঁকছি ।
তুমি নিলীন হয়ে শুয়ে আছো এখন আমার ছবির ভেতরে ।
এই ঘুম থেকে তোমাকে আমি জাগবো না ।
অস্থির পৃথিবী থেকে তুলে এনে ভালবাসার দু’হাতে...
তোমাকে এখন আমার স্থিরতার পটে স্থাপন করে চলেছি ।
পৃথিবীর সব রূপসীরা আমার পাশে দাড়িয়ে দেখছে তোমাকে,
আমি তাদের ঈর্ষা দিচ্ছি কেননা তারা স্থিরতা পায়নি ।
আমি একটু পরেই শুয়ে পড়বো তোমার পাশে-
তারপর একটু করে প্রান্তর ভরে উঠবে ঘাষে ।
কালের গ্রহণ লাগা চাঁদ তখন বেরিয়ে এসে
আমাদের দু’জনেরই ছবি আঁকবে-
যে দেখবে সে দেখবে ।
0 comments:
Post a Comment